অসমাপ্ত প্রেমের খসরা
![]() |
ভালোবাসার গলপ |
১.
মানুষ একা উপরে উঠতে পারে না। কাউকে না কাউকে ধরে তাকে উপরে উঠতে হয়। জলে ডুবলে যেমন উপর থেকে টেনে না তুললে উঠা যায় না। আমি ও’কে ধরে উপরে উঠতে চেয়েছিলাম । বুঝলেন , আমি চেয়েছিলাম একটা হাত ছবির মতো সারাক্ষণ আমার কাঁধে , বুকে -পিঠে লেগে থাকুক । মন থেকে কখন যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম , নিজেও জানি না। ও ,ওর স্বাভাবসুলভ চঞ্চলতা নিয়ে যখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াতো , আমি শিশু হয়ে যেতাম। যেন সমস্ত আবদার ওকে ঘিরে। অন্য পুরুষের সাথে ওর বন্ধুতা হোক তাতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না কিন্তু যখন জানতে পারলাম ও’র আর দশজন ছেলে বন্ধুর মতো আমিও একজন , তখন বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল । এমন স্বভাবসুলভ আত্মভোলা মেয়েটিকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না । কথাগুলো বলে ফরহাদ সাহেব একটু থামলেন , হাতে ধরা প্যাকেট থেকে ব্যানসনের একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে ধরালেন , আমি এমনিতে সিগারেট খাই না কিন্তু তখন কেনো যে ওটা হাতে ধরলাম , জানি না । খানিক দম নিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন ,‘ জানেন , আমার কোনও দোষ ছিল না , ও যখনই আসতো দেখতাম আমার জন্য সমস্ত প্রেম ওর স্বপ্নমাখা দু’চোখের মধ্যে থই থই করছে । এমন সময় কি করা উচিত , বুঝতে পারতাম না । মন চাইতো ও’র মেহেদি ছোঁপান হাত নিজের হাতে কড়োজোড়ে বসে থাকি সারাটা বেলা ।’ আমি পরিস্থিতি হালকা করতে বিষয়টি অন্যদিকে নিতে চেষ্টা করলাম । বললাম , ‘ইদানিং তেমন লিখছেন না , আপনার লেখার হাত কিন্তু খুব ভালো ।’ ফরহাদ সাহেব আমার কথায় তেমন কান দিলেন না , বুঝতে পারলাম একে আজ থামানো যাবে না । তিনি আবার বলতে শুরু করলেন ,‘এই তো এতোগুলো বছরেও ও’কে বুঝতে পারলাম না , এই যে ভালোবাসি সেটা কখনও বলিনি কেউ কাউকে কিন্তু দু’জনেই বুঝতে পারতাম ঠিক । আমি কোনও মেয়ের দিকে তাকাই , ও সেটা পছন্দ করত না , কখনও কাউকে ভালো লেগেছে বললে, ও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত । আমি বলতাম , ‘আচ্ছা সমস্যা তো , আমি কি কোনও মেয়ের প্রেমেও পড়তে পারব না ?’ ও কোনও কথা না বলে শিশিরের মতো সজল দৃষ্টিতে আমার দিতে চেয়ে থাকত শুধু । আর লেখার কথা বলছেন , আপনি তো কবি , বলুন দেখে ভালোবাসা না থাকলে দীর্ঘকাল কিছু লেখা যায় ? ওর মায়া মাখা শাসন আর অনুপ্রেরণা আমার যে কত দরকার তা যদি একটিবারও ও বুঝতে পারতো ? ও দীর্ঘকাল আমাকে না দেখে , কথা না বলে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে । আমি তো ওকে ছাড়া একটা মুহূর্ত কল্পনাও করতে পারি না ।মনের মধ্যে ওর জন্য কেমন একটা অবোধ মায়া জন্মেছে ।
কিন্তু এটাও বুঝি একজন অপ্রতিষ্ঠিত লেখকের জন্য ওর মনে করুণা ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না। আর লেখকরা প্রতিষ্ঠিত হলেই কী ? সমাজ তো আর এদেরকে ভালো চোখে দেখে না ।
ফরহাদ সাহেব বিড়বিড় করে বলে গেলেন , ‘দেখুন , একদিন আমি অনেক বড় লেখক হব। I Want to be a famous writer !’
ফরহাদ সাহেব হয়তো আরও অনেক কিছুই বলতেন কিন্তু মোবাইলে জরুরি কল আসাতে আমাকে বেরিয়ে যেতে হলো । বলে আসলাম আবার এসে বাকিটা শুনব । বের হওয়ার সময় বুকের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি আওয়াজ অনুভব করলাম । মনে হচ্ছে কি যেন দাঁত কামড়ে বসে আছে বুকের মধ্যে । কিছুতেই ছাড়বে না।
মানুষ একা উপরে উঠতে পারে না। কাউকে না কাউকে ধরে তাকে উপরে উঠতে হয়। জলে ডুবলে যেমন উপর থেকে টেনে না তুললে উঠা যায় না। আমি ও’কে ধরে উপরে উঠতে চেয়েছিলাম । বুঝলেন , আমি চেয়েছিলাম একটা হাত ছবির মতো সারাক্ষণ আমার কাঁধে , বুকে -পিঠে লেগে থাকুক । মন থেকে কখন যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম , নিজেও জানি না। ও ,ওর স্বাভাবসুলভ চঞ্চলতা নিয়ে যখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াতো , আমি শিশু হয়ে যেতাম। যেন সমস্ত আবদার ওকে ঘিরে। অন্য পুরুষের সাথে ওর বন্ধুতা হোক তাতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না কিন্তু যখন জানতে পারলাম ও’র আর দশজন ছেলে বন্ধুর মতো আমিও একজন , তখন বিষয়টি মন থেকে মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল । এমন স্বভাবসুলভ আত্মভোলা মেয়েটিকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না । কথাগুলো বলে ফরহাদ সাহেব একটু থামলেন , হাতে ধরা প্যাকেট থেকে ব্যানসনের একটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে ধরালেন , আমি এমনিতে সিগারেট খাই না কিন্তু তখন কেনো যে ওটা হাতে ধরলাম , জানি না । খানিক দম নিয়ে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন ,‘ জানেন , আমার কোনও দোষ ছিল না , ও যখনই আসতো দেখতাম আমার জন্য সমস্ত প্রেম ওর স্বপ্নমাখা দু’চোখের মধ্যে থই থই করছে । এমন সময় কি করা উচিত , বুঝতে পারতাম না । মন চাইতো ও’র মেহেদি ছোঁপান হাত নিজের হাতে কড়োজোড়ে বসে থাকি সারাটা বেলা ।’ আমি পরিস্থিতি হালকা করতে বিষয়টি অন্যদিকে নিতে চেষ্টা করলাম । বললাম , ‘ইদানিং তেমন লিখছেন না , আপনার লেখার হাত কিন্তু খুব ভালো ।’ ফরহাদ সাহেব আমার কথায় তেমন কান দিলেন না , বুঝতে পারলাম একে আজ থামানো যাবে না । তিনি আবার বলতে শুরু করলেন ,‘এই তো এতোগুলো বছরেও ও’কে বুঝতে পারলাম না , এই যে ভালোবাসি সেটা কখনও বলিনি কেউ কাউকে কিন্তু দু’জনেই বুঝতে পারতাম ঠিক । আমি কোনও মেয়ের দিকে তাকাই , ও সেটা পছন্দ করত না , কখনও কাউকে ভালো লেগেছে বললে, ও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত । আমি বলতাম , ‘আচ্ছা সমস্যা তো , আমি কি কোনও মেয়ের প্রেমেও পড়তে পারব না ?’ ও কোনও কথা না বলে শিশিরের মতো সজল দৃষ্টিতে আমার দিতে চেয়ে থাকত শুধু । আর লেখার কথা বলছেন , আপনি তো কবি , বলুন দেখে ভালোবাসা না থাকলে দীর্ঘকাল কিছু লেখা যায় ? ওর মায়া মাখা শাসন আর অনুপ্রেরণা আমার যে কত দরকার তা যদি একটিবারও ও বুঝতে পারতো ? ও দীর্ঘকাল আমাকে না দেখে , কথা না বলে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে । আমি তো ওকে ছাড়া একটা মুহূর্ত কল্পনাও করতে পারি না ।মনের মধ্যে ওর জন্য কেমন একটা অবোধ মায়া জন্মেছে ।
কিন্তু এটাও বুঝি একজন অপ্রতিষ্ঠিত লেখকের জন্য ওর মনে করুণা ছাড়া আর কিছুই থাকতে পারে না। আর লেখকরা প্রতিষ্ঠিত হলেই কী ? সমাজ তো আর এদেরকে ভালো চোখে দেখে না ।
ফরহাদ সাহেব বিড়বিড় করে বলে গেলেন , ‘দেখুন , একদিন আমি অনেক বড় লেখক হব। I Want to be a famous writer !’
ফরহাদ সাহেব হয়তো আরও অনেক কিছুই বলতেন কিন্তু মোবাইলে জরুরি কল আসাতে আমাকে বেরিয়ে যেতে হলো । বলে আসলাম আবার এসে বাকিটা শুনব । বের হওয়ার সময় বুকের মধ্যে কেমন একটা খচখচানি আওয়াজ অনুভব করলাম । মনে হচ্ছে কি যেন দাঁত কামড়ে বসে আছে বুকের মধ্যে । কিছুতেই ছাড়বে না।
২.
কাল রাতে সিগারেট খেয়েছি । এই প্রথম । পুরো এক প্যাকেট । আবছা মনে পড়ে , ফরহাদ সাহেবের ওখান থেকে বের হয়েই চারুর কথা মনে পড়ে গেল । ফরহাদ সাহেবের গল্পের সাথে নিজের গল্পের কোথায় যেন মিল খুঁজে পাচ্ছি । মাথার মধ্যে এলোমেলো ভাবনাগুলো দলা পাকিয়ে আসছিল। রোজকার ভাত , মাছ , গোসলের মতো চারুও তো আমার ভাবনা জুড়ে বসে থাকে আজকাল।
জরুরি কাজ শেষ করে রমনার পথ ধরে যখন হাঁটছিলাম , আলো-আঁধারিতে বন্ধু মাসুদের সাথে দেখা হয়ে গেল । এই জন্যই ওকে আমার এত ভালো লাগে , যখনই আমি কোনও সংকটে পড়ি , ও দিব্যি এসে হাজির । ও সব বুঝতে পারে । বলল ,‘ চারুর সাথে কথা হয় না অনেকদিন , তাই না ? ’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম । ও আমার কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে বলল , ‘ এবার বলে দে ।’ আমি বললাম , না , ‘এখনও সময় হয়নি ।’ সে সময় আমার কখনও হবে না , মনে মনে বললাম । ও কতটা বুঝতে পারল তা ও নিজেই জানে । পকেটে আস্ত ঐ সিগারেটের বাক্সটা দিয়ে বলেছিল ,‘ এটা থেকে সান্তনা পেতে পারিস ।’ রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলাম ।
বাসায় ফিরে দেখি ভাত রান্না নেই , ফ্রিজে কিছু ফল রাখা আছে , তাই খেলাম । ধূমায়িত কফির পেয়ালাতে চুমুক দিয়ে লিখতে বসলাম , লিখতে বসে মনে পড়ল ফরহাদ সাহেবের কথা ‘ আপনি তো কবি , বলুন দেখি ভালোবাসা না থাকলে দীর্ঘকাল কিছু লেখা যায় ? ’ সত্যিই তো আমি কিছুই লিখতে পারছি না । গোঙানির মতো নিজের অজান্তেই মুখ থেকে একটি আওয়াজ বেরিয়ে এলো ‘ চারু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি । ’
সিগারেটের বাক্সটা হাতে নিয়ে তা থেকে একটি ধরিয়ে নিলাম । প্রথম টানে মাথার মধ্যে কেমন একটা ঝিম অনুভূতি হলো , দলা পাকিয়ে বমি আসতে চাইছিল কিন্তু সেটা বেশি সময়ের জন্য নয় , একটু পরেই আমার চোখের সামনে পরিচিত পৃথিবীটা পাগলের মতো উলঙ্গ হয়ে যেতে লাগল । গ্রীষ্মের এই ভ্যাপসা গরমেও আমার কানের লতির পাশ দিয়ে একটা গভীর শীতল অনুভূতি কণ্ঠনালী ভেদ করে পেটের মধ্যে চলে গেল । চেনা পৃথিবীটা এক মুহূর্তে অচেনা হয়ে গেল , সেই অপরিচিত মিররে অনেকের মুখই ভেসে উঠতে লাগল । গলির মুখে রোজ ডেকে যাওয়া তরকারিওয়ালা , কখনও দেখিনি এমন একজন রিকশাওয়ালা , নানাবুজি –যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম , বাবার মুখ ভেসে এলো , গ্রামে আমাদের তালগাছ থেকে রস ঝরাতো যে ছেলেটা –তাকে ( ও আমাকে মস্ত একটা ঢাউসঘুড়ি বানিয়ে দিতে চেয়েছিল , বলেছিল , এই ঘুড়ি নাকি আমাকে শুদ্ধ উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে , আমি ওই ঘুড়িতে চড়ে কামরুখকামাকখার দেশে যেতে চেয়েছিলাম , ওর কাছেই গল্পটি শোনা । ছেলেটি অল্প বয়সেই মরে গেছে ), আরও পরিচিত , অল্প পরিচিত, অপরিচিত অনেকগুলো মুখ ভেসে উঠতে লাগল । এভাবে কখন যে পুরো এক প্যাকেট শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে করতে পারছি না ।
ঘুমের মধ্যে সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম । স্বপ্নে দেখলাম , আমার শোবার ঘর হঠাৎ স্বর্গীয় আলোতে ভরে ওঠেছে , সেই আলোতে দেখতে পেলাম চারু এসে বসেছে আমার পাশে । আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । আমি কিছু বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ও ঠোঁটে হাত দিয়ে আমাকে থামিয়ে দিলো । আমি ওর এক হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওর চিরুনির দাঁতের মতো সরু আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করছিলাম । দেখি , ওর মেঘের মতো চুলের ঢেউ আস্তে আস্তে আমার মুখের উপরে এসে থেমে গেছে । হঠাৎ ঝড়ের পর আকাশ যেমন স্থির অবিচল হয়ে থাকে , ও আমার মুখের ওপরে ঐ ভাবে স্থির হয়ে আছে । আমি তখন ওর শ্যাম্পু করা চুলের গন্ধে পাগলপ্রায় । ও তখন আমার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসছে । ওর মিসরির মতো মিষ্টি ঠোঁট যখনই আমাকে স্পর্শ করতে যাবে , এমন সময় ও এক ধাক্কায় আমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল । দেখলাম , ও পেছন ফিরে চলে যাচ্ছে , যাবার সময় বলে গেল , ছিঃ ! তুমি গাঁজা খেয়েছ , এতো নিচে নেমে গেলে !
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সারাটা মুখ তেতো হয়ে আছে । ইউরিন ত্যাগ করতে গিয়ে দেখি পেশাবের রাস্তায় জ্বালা-পোড়া করছে । বুঝতে পারলাম , বন্ধু সত্যিই সিগারেটের ভেতরে গাঁজা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ।
৩.
মধ্য আকাশে গণগণে সূর্য তখন রুপোর থালার মতো পৃথিবীকে ভাজছে । যাকে বলে ডগ-ডে । এমন সময় তটস্থ ফরহাদ সাহেব ঘামে ভেজা জবজবে শরীর নিয়ে আমার রুমে ঢুকলেন । তার সারা দেহে ক্লান্তির ছাপ । মুখে এক সপ্তাহের না কামানো দাড়ি । আমি দ্রুত এক গেলাস পানি এনে দিলাম । উনি এক নিশ্বাসে তা শেষ করলেন । দম নিতে কিছুটা সময় দিয়ে তারপর বললাম , এই এক সপ্তাহ কোথায় ছিলেন ? আমি আপনার ওখানে তিনদিন গিয়ে ফিরে এসেছি । তারপর যা বললেন তা এরকম , ‘ঐ দিন আপনি চলে যাবার পর খবর পাই বাবা খুব অসুস্থ , ঐ রাতেই বাড়ির পথে রওনা দিই । গিয়ে দেখি উনি আর নেই । আমাকে মিথ্যা বলে ঢাকা থেকে বাড়ি নেওয়া হয়েছিল । আপনাকে যে একটা ফোন দিব সে সুযোগ পর্যন্ত ছিল না । ’
আমি নিজেও বাবা হারিয়েছি , এই মুহূর্তে তাকে কি বলে সান্তনা দিব , সে ভাষা আমার জানা নেই ।
দুপুরে এক সাথে খেলাম । আমার লেখা কয়েকটা পাণ্ডুলিপি দেখালাম ফরহাদ সাহেবকে । তার মধ্যে একটা গল্পও ছিল । তিনি বললেন , ‘গল্প লিখছেন আজকাল ? ’ ‘চেষ্টা করি ’ লজ্জিত ভাবে বললাম । তিনি অভয় দিলেন , খানিকটা পড়ে বললেন ,‘বেশ হচ্ছে , চালিয়ে যান ।’ সারাটা দুপুর দুজনে আড্ডা দিয়ে কাটালাম । ফরহাদ সাহেবকে ইদানিং বেশ ভালো লাগছে , নিজের সাথে উনার অনেক মিল খুঁজে পাই বলে হয়তো । যদিও উনি বয়সে আমার থেকে চার বছরের বড় ।
ফরহাদ সাহেব যাকে ভালোবাসে , মেয়েটির নাম –ফরহাদ সাহেব নিজেই দিয়েছেন ‘অধরা’ । আমি বললাম , কেনো দিলেন এমন নাম ? উনি বললেন , যা সহজে ধরা যায় না তাই তো অধরা , আমি ওকে ধরতে পারলাম কই ? মনে মনে বললাম , কবি লেখকের জাতটা একটু আবেগি হয় , হাসলাম কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ।
প্রাচীন বৃক্ষের মতো আমার মাথার মধ্যে একটা বোধ খেলা করে গেল । অস্পষ্ট দেখতে পেলাম অনেকগুলো চেনা মুখ আমাকে ডাকছে ।আমি তাদেরকে ভালোবেসে একটি করে নাম দিয়েছিলাম । মানুষ ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবেসে অন্য নামে ডাকে , যে নামে তাকে আর কেউ ডাকে না । ওরা একে একে সবাই চলে গেছে , চারুও চলে যাবে একদিন। চারু –নামটি আমার দেওয়া । ওর ডাক নামের আড়ালে এই নামটি ঢাকা পড়ে যাবে , আমি ছাড়া এই নামে ওকে আর কেউ ডাকবে না , আমি তা চাইও না । ও শুধু আমার। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বিগত সব নামগুলোর থেকে ‘চারু’ নামটিই আমার সমস্ত জুড়ে বসে আছে ।
ফরহাদ সাহেব আমাকে মৃদু ধাক্কা দিলেন । সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললাম , বলুন আপনার অধরার গল্প ।
রাত দশটা অব্দি ফরহাদ সাহেব তার অধরার গল্প বলে চললেন , এই এতোটা সময় তিনি আমাকে কোনও কথা বলবার সুযোগ দেন নি , আমি কখনও মাথা নেড়ে আবার কখনও হু , হা –শব্দ করে গল্পের আসর জমিয়ে রেখেছি মাত্র । মাঝে তিন প্রস্থ চা আর বিস্কুট ।
ফরহাদ সাহেব অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন । ধাঁই ধাঁই করে পা ফেলছেন , দেখে খুব নির্ভার মনে হচ্ছে তাকে । এই এবড়োখেবড়ো ধুলোমাখা পথ বেয়ে তিনি তার বাড়ি যাচ্ছেন । বাড়ি বলতে ভাড়া বাড়ি । রাজাবাজার ।
আমি পড়ে রইলাম একা । হিস হিস শব্দ করে রাত বারোটার ট্রেন ঢাকা ছেড়ে উত্তরবঙ্গের দিকে চলে গেল । বুকসেল্ফ থেকে প্লেটোর রিপাবলিক নিয়ে পড়তে শুরু করলাম , পারলাম আর কই । নীতি –নৈতিকতা কিছুই চোখে পড়ে না , গোটা পৃষ্ঠা জুড়ে শুধু একটি নাম লেখা বলেই মনে হচ্ছে – চারু । মাঝেমধ্যে মুখটিও ভেসে উঠছে । এ এক অদ্ভুত হ্যালুসুনেশন ।
বই বন্ধ করে ছাদে গেলাম । আকাশটা বেশ পরিষ্কার , পূর্ণিমার দুদিন বাকি , গোটা চরাচরময় অদ্ভুত নৈশব্দ বিরাজ করছে , সেটা স্বাভাবিক । রাত দুটোর পরে নববিবাহিত আর সামনে পরীক্ষা – এমন লোক ছাড়া খুব অল্প লোকই জেগে থাকে । আমি হেঁটে হেঁটে ছাদের একেবারে পশ্চিম কোণটায় গিয়ে দাঁড়ালাম , পাশেই ছাতিম গাছ , সেই গাছ থেকে আমার দিকে একজোড়া চোখ তাকিয়ে আছে । ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম । না ভুত নয় একটি রাতজাগা প্যাঁচা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে । মনে মনে আনন্দ পেলাম , যাক নিশিযাপনের একজন সঙ্গী অন্তত পাওয়া গেল ।
৪.
বছর বাদে ফরহাদ সাহেবের সাথে আবার দেখা , এখন আমার বাসাতে উনি আসেন না । সময় হয় না , বুঝতে পারি । বিয়ে করেছেন মাস ছয় হলো । নিজের পছন্দের নতুন প্রেম এখন তার জীবনসঙ্গী । প্রেম বসন্তে বসন্তে এভাবেই চেন্জ হয় । সুখে আছেন , দেখেই বোঝা যায় । নগর ঢাকাতে সুখ পাওয়া যায় না , উনি সুখে আছেন জেনে ভালো লাগল । বই মেলাতে উনার তিনটি বই বের হয়েছে । বেস্ট সেলার। একটি উপন্যাস , দুটি গল্পের বই । জানতে চাইলেন কিনেছি কি না ? আমি সলজ্জ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম । কী করে বুঝাব , এই শহরে চাইলেই কেউ কেউ দুইতিন শ টাকা দিয়ে একটি বই কিনতে পারে না ।
বিষয়টি হয়তো উনি বুঝতে পারলেন । সদ্য প্রকাশিত বেস্টসেলার তিনটি বইই অটোগ্রাফ সমেত আমার হাতে তুলে দিলেন । আমার তখন লজ্জায় সারামুখ লাল হয়ে গেছে ।
"এখন চাইলেই আপনাকে কল করতে পারি না, দ্বিধা এসে আমার গলা চেপে ধরে। অথচ একটা সময়....! ফোন করেছেন কেনও ? আমাকে আর বিরক্ত করবেন না "
বলেই কল কেটে দিলেন ফরহাদ সাহেব।
আমি তাকিয়ে থাকি ফরহাদ সাহেবের দিকে। এক সময় ফরহাদ সাহেব যার কথা ছাড়া অন্য কোনও কথা বলতেই পারতেন না, আজ কতো সহজে তার ফোন কেটে দিলেন। জীবন এমনই, বেশিদিন কাউকে মনে রাখে না।
কিন্তু আমি ভিন্ন।
ফরহাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, কই আমি তো চারুকে ভুলে থাকতে পারছি না। পারব না।
ফরহাদ সাহেব আমার দিকে মনোযোগ দিলেন । বললেন , আপনার গল্পও খুব ভালো হয় । লিখুন , লিখতে থাকুন । আমি নিজের দিকে তাকালাম , মনে মনে বললাম লিখছি তো আমার প্রতিদিনের যাপন কাহিনী , আমার অব্যক্ত প্রেমের গল্প –চারু ।ওকে ঘিরে কাটানো সময়ের গল্প । কিছুই ফেলনা নয় আজ।
আমার অসামাপ্ত প্রেমের গল্প
আমার অসমাপ্ত সময়ের জাবরকাটা , সবই চলছে সমান তালে , চলবে।
আর কী আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে আছি !
এটাও তো একটা গল্প । জীবনে কিছু গল্পের শেষ টানতে নেই , কিছু স্ম্পর্কও শেষ হয় না কখনও ।
আমার আর চারুর প্রেমের গল্পও শেষ হবার নয় ।
দশবছর পর….
বই মেলায় দেদারছে আমার বই বিক্রি হচ্ছে । সবাই অটোগ্রাফ নিচ্ছে ।
আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি ।
সবাই জানতে আগ্রহী , চারু মেয়েটি কে ?
ভিড়ের মাঝে একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন , বললেন অটোগ্রাফ দিন !
নাম ? আমি জানতে চাইলাম ।
‘চারু ’ সে বলল ।
পাঠকের লক্ষ্যবিন্দু এখন চারু ।
পাঠক এখন চারুকে ঘিরে ধরেছে । অটোগ্রাফ নিচ্ছে ।
আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম চারুর দিকে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন