
উর্দু কবি সাগর সিদ্দিকী । তাঁর জীবন ছিল বোহেমিয়ানতায় মোড়া। মারা গিয়েছিলেন বেশ অল্প বয়সেই। মৃত্যুর সময় যে কবির একমাত্র স্বজন ছিল তাঁর কুকুর। তাঁর গজলগুলো মূল উর্দু থেকে অনুবাদ করে এই কবির সমন্ধে লিখেছেন জাভেদ হুসেন।
ষাটের দশকে লাহোরের আনারকলি বাজার, আইবেক রোড, দাতা দরবার এলাকায় দেখা যেত জট লাগা চুল, শীত–গ্রীষ্ম সব সময় গায়ে একটা কালো কম্বল জড়িয়ে একজন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। থাকতেন ফুটপাতে। সংসার বলতে একটা কেরোসিনের চুলা, তাতে অষ্টপ্রহর চায়ের জল চড়ানো। আর সঙ্গী এক কুকুর। ফুটপাতেই মোমবাতি জ্বালিয়ে মুশায়েরা, মানে কবিদের আসর বসাতেন। লাহোরের বড় কবিরা তাতে নেমন্তন্ন পেলে গর্ব বোধ করতেন। লাহোরের দুর্দান্ত শীতে ঘুমানোর জায়গা ছিল খাবার হোটেলের তন্দুর রুটি বানানোর নিভিয়ে দেওয়া চুলার ওপর বিছানো সেই কম্বল। এই হলেন কবি সাগর সিদ্দিকী। উর্দুতে সাগর মানে পানপাত্র।
সাগর সিদ্দিকী জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের আম্বালায় ১৯২৮ সালে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান হয়ে। ১৯৪৭ সালে ১৯ বছরের যুবক কবি লাহোরে পাড়ি জমান। সিনেমার পরিচালক থেকে শুরু করে মেহেদি হাসান খাঁ সাহেবের মতো গাইয়েরা গিয়ে ফুটপাতে তাঁর পাশে বসে থাকতেন গজল নিয়ে যাওয়ার জন্য।
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসের এক ভোরে সাগর সিদ্দিকীকে ফুটপাতে মৃত পাওয়া গেল। কবির বয়স তখন ৪৬ চলছিল। শেষ সময়ে কাছে ছিল তাঁর একমাত্র স্বজন বন্ধু কুকুরটি। এর পর থেকে সেই কুকুর সাগরের মৃত্যুর স্থানটি ছেড়ে যায়নি। এক বছর পর সেও মারা যায় একই স্থানে।
সাগর সিদ্দিকীর গজল থেকেঃ
১.
দিল মিলা অওর গম শানাস মিলাফুল কো আগ কা লিবাস মিলা
(বেদনাকে চেনে এমন হৃদয় পেয়েছি
ফুল পেয়েছে আগুনের পোশাক)
২.
ম্যায়কাদে কে সিওয়া হামারা পাতাউনকি জুলফোঁ কে আসপাস মিলা
(পানশালা ছাড়া আমার খোঁজ
তার কালো চুলের আশপাশে পাবে)
৩.
মওত ক্যাহতে হ্যাঁয় জিসে অ্যায় সাগরজিন্দেগি কি কোয়ি কড়ি হোগি
(মৃত্যু বলে যাকে হে সাগর
জীবনেরই কোনো পর্ব হবে হয়তো)
৪.
ভুলি হুয়ি সদা হুঁ, মুজে ইয়াদ কিজিয়েতুম সে কাহিঁ মিলা হুঁ, ইয়াদ কিজিয়ে
(ভুলে যাওয়া কোনো ডাক আমি, আমাকে মনে করো
কোথাও মিশে আছি তোমার সঙ্গে, আমাকে মনে করো)
৫.
হ্যাঁয় দুয়া ইয়াদ মাগার, হর্ফে দুয়া ইয়াদ নেহিঁমেরে নগমাত কো আন্দাজে নওয়া ইয়াদ নেহিঁ
(প্রার্থনা মনে আছে, ভুলেছি প্রার্থনার শব্দ
আমার গানেরা ভুলেছে সুরের চলন)
৬.
অ্যায় আদম কে মুসাফিরোঁ হোঁশিয়াররাহ মেঁ জিন্দেগি খাড়ি হোগি
(ওহে মৃত্যুপথের পথিকেরা সাবধান,
পথে হয়তো জীবন ওত পেতে আছে)
৭.
জিন্দেগি জব্রে মুসালসাল কি তরহা কাটি হ্যায়জানে জিস জুর্ম কি পায়ি হ্যায় সাজা, ইয়াদ নেহিঁ
(নিরন্তর নির্যাতনের মতো কেটেছে জীবন
কোন অপরাধের পেয়েছি সাজা, তা–ও মনে নেই)
৮.
চারাগে তুর জ্বালাও, বড়া আন্ধেরা হ্যায়জারা নাকাব উঠাও, বড়া আন্ধেরা হ্যায়
(তুর পাহাড়ের প্রদীপ জ্বালাও, বড় অন্ধকার
অবগুণ্ঠন একটু সরাও, বড় অন্ধকার)
৯.
গম কে মুজরিম হ্যায়, খুশি কে মুজরিম হ্যায়লোগ আব জিন্দেগি কে মুজরিম হ্যায়
(দুঃখে অপরাধী, আনন্দেও অপরাধী
মানুষ এখন জীবনের দায়ে অপরাধী)
১০.
নগমোঁ কি ইবতিদা থি কাভি মেরে নাম সেআসকোঁ কা ইনতিহা হুঁ, মুঝে ইয়াদ কিজিয়ে
(সুরের শুরু হতো কখনো আমার নামে
অশ্রুর শেষ আজ আমি, আমাকে মনে করো)
১১.
দেখা জো রকস করতি হুয়ি মওজে জিন্দেগিমেরা খায়াল ওয়াক্ত কি শেহনায়ি বন গ্যায়ি
(দেখলাম যখন নেচে ওঠা জীবনের স্রোত
আমার ভাবনা কালের সানাই হয়ে বেজে উঠল)
১২.
তেরি সুরত জো ইত্তিফাক সে হামভুল জায়েঁ, তো কেয়া তামাশা হো
(যদি ঘটনাক্রমে তোমার মুখ
ভুলে যাই, তবে কেমন তামাশা হবে)
১৩.
চারাগে তুর জ্বালাও, বড়া আন্ধেরা হ্যায়জারা জুলফ উঠাও, বড়া আন্ধেরা হ্যায়
( পাহাড়ের প্রদীপ জ্বালাও, বড় অন্ধকার
একটু কেশরাজি সরাও, বড় অন্ধকার)
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন