সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। আজকে ইউনিভার্সিটিতে যেতেই হবে। কারন সেমিষ্টারের পরিক্ষা আছে। কাজেই বেড়িয়ে পরলাম। বাড়িতে আমাকে নিয়ে কেউ ভাবে না। কাজেই আমি থাকলাম কি গেলাম এই নিয়ে কেউ ভাবে না।শিলিগুড়িতে ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। তারমধ্যেই নকশালবাড়ি রুটের বাস ধরলাম।বাসে তেমন কোন ভীড় নেই। আমি বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। শিবমন্দিরে নেমে দেখি প্রচন্ড জোরে ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। কোনমতে রাউতদার রেস্টুডেন্টের সামনের বারান্দায় ভীড় ঠেলে উঠলাম। খুব ভীড়। দেখি ইউনির্ভাসিটির ছেলেমেয়েরাই বেশি। দুটে মেয়ের পাশে দাড়ালাম। অতি সাধারণ চেহারা। দেখি রাউতদার কর্মচারী চা দিয়ে গেল। বলল "শিবুদা পাঠাইল তোমাকে দেখিবার পাইছে"। বললাম খালি আমি আরও দুই কাপ আন । মেয়েগুলো না না করতে লাগল । আমি মেজাজ নিয়ে বললাম তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। কর্মচারি টা চলে গেল। একটু পরে দুই কাপ চা নিয়ে এসে বলল "শিবুদা বিকালে আসতে কইছে"। মেয়ে দুটো চা নিতে ইতঃস্তত করছিল। আমি বললাম খান না, না হয় আর এক দিন খাইয়ে দেবেন। বৃষ্টির ঝাপটা লাগছিল সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। রাস্তা দিয়ে কিছু গাড়ি বাস কাকভিজা হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের সবগুলো দোকানের শেডের নিচে লোক দাড়িয়ে আছে। আমি গল্প শুরু করলাম। বললাম আপনারা কোন ডিপার্টমেন্টের। একটু ফর্সা মেয়েটা বলল আমি পল সায়েন্স আর ও তো আপনার ডিপার্টমেন্টে পরে। একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম। প্রায় দুই মাস হয়ে গেল ভর্তি হয়েছি এখনও সবাই কে চিনি না।বানিয়ে বললাম আসলে বৃষ্টিতে ভিজে গেছেন বলে ঠিক চিনতে পারি নি । তার পর বাড়ি কোথায় এসব কথা হোল। হা হয়ে গেলাম যখন শুনলাম ওরা রাত আড়াইটার সময় বাড়ি থেকে বের হয়েছে। প্রথমে ট্যাক্সি করে মাথাভাঙ্গা সেখান থেকে চারটার সময় শিলিগুড়ির বাস ধরে শিলিগুড়িতে আবার সারে নটার বাস ধরে শিবমন্দিরে।
এভাবে কিছু ক্ষন সময় কাটানোর পর বৃষ্টি ধরে এল। এখান থেকে প্রায় এক কিলো মিটার দূর হবে হোষ্টেল। মেয়েদের হোষ্টেল অবশ্য অনেক আগে। আমার সঙ্গে ঐ মেয়েগুলো রওনা হোল। আমাকে একটা ছাতা দিল। আমি তো ভেবেছিলাম এক দৌড়ে হোষ্টেলে চলে যাব। কিন্তু মেয়েগুলোর সামনে কি করে যাই। ওদের ছাতা নিলাম। মেয়ে দের হোষ্টেলে র সামনে ছাতা ফেরত দিতে গেলে বলল। ভিজে যাবেন তো। পরে ক্লাশে দিয়ে দেবেন।
হোষ্টেলে গিয়ে রেডি হয়ে মেয়েটার ছাতা নিয়ে ডিপার্টমেন্টে গেলাম। দেখি অদ্ধেকের বেশি ছাত্রছাত্রীই ক্লাশে আসেনি। ডিপার্টমেন্টের হেড এসে বললেন এই অবস্থায় সেমিষ্টার হবে না। টিফিনের আগে আর ক্লাশ হবে না। আমি ঐ মেয়েটাকে ছাতা ফেরৎ দিয়ে কি করব তাই ভাবছি। দেখি মেয়েটা চলে যাচ্ছে। আমার কি মনে হল মেয়েটাকে বললাম চলুন না চা খাই। রাজি হয়ে গেল।গিয়ে দেখি কফিহাউসে ভীড়। কোন ডিপার্টমেন্টে ই ক্লাশ হয়নি। আমার সঙ্গে কফি হাউজের ম্যানেজারের বেশ খাতির আছে। উনি পাশের স্পেশাল ঘরের তালা খুলে দিয়ে বলল আপনারা ওখানে বসুন। দারুন সাজান গোছানো কেবিনে বসে চা আর মোগলাই পরোটার অর্ডার দিলাম। এবার মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় শুরু করলাম । নাম নীলিমা ঈব্রাহিম বাড়ি কুচবিহারের শিতলকুচিতে। এবার অনার্সে ইউনিভার্সিটিতে ফাষ্ট হয়েছে। এবার আমার পালা বলল সবাই আপনাকে চেনে। আমাকে চমকে দিয়ে বলল ভালো করে পড়াশনা করেন না কেন। হেড স্যার বলে পড়াশুনা করলে ভাল রেজাল্ট করবে।আমি দেতো হাসি হেসে বললাম এবার থেকে করব। নীলিমা হেসে ফেলল। এই প্রথম আমি হাসতে দেখলাম। খাওয়া এসে গেল। পেমেন্ট দেবার বেলায় ও বলল এবার আমার পালা। আমি বললাম তাহলে মোগলাই ফিপটি ফিপটি। ও আবার হাসল। লক্ষ করলাম হাসলে গালে টোল পরে। ভাল লাগতে শুরু হল।
বিকালে আমি ট্রাক স্যুট পরে জগিং করতে যাই। দুই নম্বর গেট দিয়ে ঘুরে শিবমন্দির বাজারে। ক্লাবে ব্যায়াম করি তারপর আড্ডা মেরে নটা নাগাদ হোষ্টেলে আসি।সোজা ডাইনিং রুমে খাবার খেয়ে ঘরে যাই। স্নান করে কোনদিন একটু বই উল্টাই।রেডিওতে গান শুনি। আমাদের তলার স্বদেশ আমার ভাল সাপোর্টার। খবর দিল আজকে আমাকে আর নীলিমাকে নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে। বললাম বাদ দাও। বিন্দাস থাক। ওর কাছেই জানলাম নীলিমা দারুন গান গায়। পরিবারের খবরও পেলাম ওর দাদু সেই আমলের হাজী।বাড়ির সামনে মসজিদ দিয়েছে। কয়েকশ বিঘা জমি ছিল (যদিও অনেক জমি দখল হয়ে গেছে)।বাবা একটা স্কূলের হেডমাষ্টার। প্রচুর সন্মাণ। ও মাথাভাঙ্গা কলেজের সেরা ছাত্রী। এবার বাংলা অনার্সে নর্থ বেঙ্গলের মধ্যে ফাষ্ট হয়েছে। গানে কুচবিহারের একজন সেরা গায়িকা। অনেক রেডিও প্রোগ্রাম করে।মনে মনে ভাবলাম সাবধান এখানে লাইন মারতে যেও না।স্বদেশ আরও বলল তোমার সঙ্গে ও কেন চা খেতে গেল এটা আমরা খুব আলোচনা করেছি। অবশ্য তুমি একজন হিরো। বললাম গুলি মার। চা খাওয়াও। স্বদেশের ঘরে স্টোভ আছে। ও মাঝ রাতে চা বানিয়ে খায়।
পরদিন সকালে জগিং করতে অডিটোরিয়ামের দিকে গেছি। দেখি ইংরাজীর মন্জুসা চক্রবর্তী আর একটা মোটা মেয়ে হাটছে। আমাকে দেখে দুজনে কিছু বলাবলি করছিল। কাছে গেলে বলল আচ্ছা আপনি কি অজিত ব্যানার্জীকে চেনেন। বললাম উকিল। মাথা নাড়ল। বললাম আমারা এক পাড়ায় থাকি। বলল মাসি আপনার কথা বলেছিল। হাসলাম। বললাম আবার দেখা হবে। একটু অবাক হল। সবাই ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য মুখিয়ে থাকে। আর আমি তেমন পাত্তা দিলাম না।
আসলে মন্জুসা চক্রবর্তী ইউনিভার্সিটির এক নম্বর নাম। অসাধারন সুন্দরী। ইংরাজী অনার্সে ফাষ্ট হয়েছে। আমি আর একটা জিনিষ ভাবলাম। কি ব্যাপার নীলিমা এত পাত্তা দিল। মন্জুসা যেচে কথা বলল।আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের বড় লোকের ল্যাডলি আলপনা বসু অন্য চোখে দেখে। শালা আমার মত গান্ডুও এত হিরো হল কি করে?
পূজো এসে গেল। প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। বৃষ্টি কমে গেল। ছেড়া ছেড়া মেঘ। নীল আকাশ। দূরে কান্চনজঙ্ঘা মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে।সকালে জগিংএ যাবার সময় কুয়াসার আভাস পাই। গরম অনেক কমে গেছে।শিবমন্দিরে আমাদের ক্লাবের বিশাল প্যান্ডেল হচ্ছে। ষষ্ঠীর দিন ফান্সন হবে।আমি তার জন্য প্রাকটিস করছি। ফান্সন করেই বাড়ি যাব।
ডিপার্টমেন্টে ছুটি হবে ষষ্ঠীর আগের দিন। সিক্স ইয়ারের দাদা দিদিরা ঠিক করল ষষ্ঠীর আগের দিন একটা ডিপার্টমেন্টাল শারদ উৎসব করবে। সান্চারী দি উমেশ দা আরো অনেকে ভালো রবীন্দ্র সংগীত শিল্পি। আমাদের ডিপার্টমেন্টে নীলিমা আলপনা আরও কয়েকজন গান গাইবে।দু একজন আবৃত্তি করবে।আমাকে বাজাতে বলল। ঠিক আছে চলবে। এই দুই দিন ক্লাশ চলল। সবার বাড়ি যাবার মুড। অনেকে নোটস /বই বিনিময় করল। ঠিকানা নেওয়া চলল। আমি কোন নোটস বিনিময় করলাম না। কারন আমি তো কোন নোটসই টুকি নি। বইও ঠিকমত নেই।লাইব্রারী থেকে তো গল্পের বই আনি। আমাকে অবাক করে নীলিমা জিজ্ঞাস করল আপনি নোটস আনেন নি। আমি হাসলাম মাত্র।ও হয়ত অবাক হোল। আর কিছু বলল না। খালি জিজ্ঞাস করল কবে যাবেন। বললাম সপ্তমীর সকালে।
ষষ্ঠীর আগের দিন আমাদের ডিপার্টমেন্টে ফান্সন শুরু হল। ছেলেরা সবাই পান্জাবি ধূতি পাজামা আর মেয়েরা লাল পার শারী পরে এল। আমার তো পান্জাবী নেই আমি একটা লাল টকটকে গেন্জি আর সাদা প্যান্ট পরে গেলাম। আমাকে হেড স্যার বলল "তোমারে তো ভালই দেখাইতেছে"।দুএকজনের চোখে প্রশংসা দেখলাম। উৎসব খুব ভালো হল। প্রো ভাইস একজন বিখ্যাত কবি। তিনি উপস্থিত ছিলেন। খুশিই হোলেন। আমি কয়েকটা রবীন্দ্র/ নজরুল সংগীত বাজালাম। অনেকেই ভালো গান /আবৃত্তি /গিটার বাজাল। সবাইকে চমকে দিয়ে নীলিমা কয়েকটা গান গাইল। কি সুন্দর গলা। প্রো ভিসি থেকে সবাই প্রশংসা করল। এবার খাওয়া দাওয়া হল। সবাই কিছুক্ষন হৈ হৈ করল। আলপনা আমাকে বলল ও যদি জলপাইগুড়ি যায় তবে আগে ফোন করবে। দেখলাম নীলিমা এক কিনারে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। আমি সাহস করে বললাম কাল কি করছেন। হাসল বলল বাড়ি যাবার প্রস্তুতি। বললাম সন্ধায় আমাদের প্রোগ্রামে গান করুন না। ও বলল দেখি সুপার রাত্রে যেতে দেবে কি না। বললাম ও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বলল কি রকম গান গাইতে হবে বললাম হিন্দি হলে ভাল না হলে আধুনিক। ও বলল আচ্ছা চেষ্টা করব। সবাই যে যার জায়গায় রওনা হয়ে গেল। আমাকে হেডু বলল" বাড়িতে এ কদিন একটু বই টই খুইল্যা দেইখও।"আমি হ্যা স্যার বলে কেটে পরলাম।
ক্লাবে গিয়ে শিবু সেনকে নীলিমার গানের ব্যাপারটা বললাম। বলল এই কেস। বলল সুপারকে আমি ফিট করে দিচ্ছি।ঠিক হলো শিবু সেন নীলিমাকে গাড়ি করে নিয়ে আসবে তাড়াতাড়ি গান গাইয়ে পৌছে দেবে। সেইমত শিবু সেন ব্যবস্থা করে ফেলল।
ষষ্ঠীর দিন হোষ্টেলে মেয়েদের হোষ্টেলে গিয়ে বললাম নীলিমা ইব্রাহীম কে এ ডেকে দিতে। নীলিমা বেড়িয়ে এল। বললাম কি করছেন। চলুন ঘুরে আসি।বলল একটু রেডি হয়ে নি।আমার সঙ্গে মিষ্টু যাবে। বললাম অবশ্যই। এবার বলল আমাকে আপনার ক্লাব থেকে বলে গেছে। সুপারও রাজি হয়েছে। বললাম আমি যখন ইনস্টুমেন্ট নিয়ে যাব তখন আপনাকে নিয়ে যাব। প্রথমে গান গাইয়ে পৌছে দেব। বলল ঠিক আছে।
.
হঠাৎ আমার কি মনে হোল শিবু সেনকে ফোন করলাম ওর গাড়িটা পাঠাতে।বললাম একটু কার্সিয়াং যাব। বলল পনের মিনিটের মধ্যে কিশোর শর্মা গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। ওকে চিনি। বললাম কার্সিয়াং ঘুরে পাচটার মধ্যে ফিরতে পারব। বলল পাঙখা বাড়ি দিয়ে যাব। আমি ইউনিভার্সিটি এরিয়ার বাইরে ওকে দাড়াতে বললাম। একটু পরে নীলিমা আর সেই দিনের মেয়েটা এসে দাড়াল বলল ওই মিষ্টু ভালো নাম মল্লিকা মিশ্র। পল সাইন্সে পরে। বললাম পিছন দিক দিয়ের গেট দিয়ে চলুন। বাইরে এসে বললাম গাড়িতে উঠুন। একটু ইতস্তত করছিল। বললাম কার্সিয়াং যাব। পাচটার মধ্যে চলে আসব। আমরা মিলিটারি ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে চললাম। দুপাশে মিলিটারি কোয়ার্টার পার্ক ফুলের বাগান সব সুন্দর ভাবে সাজানো। মোহরগাও থেকে আমরা আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। দুপাশে জংগল চা বাগান। আর একটু আগে পাংখাবাড়ি বাজার। ছোট ছোট কাঠের বাড়ি। এখান থেকে খাড়া রাস্তা উঠে গেছে কয়েক পাক দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার ফুট উপরে উঠে এলাম। এখানে ভিও পয়েন্টে কিশোর গাড়ি দাড় করাল। ওখানে দাড়িয়ে জঙ্গল চা বাগান নদী সব ওদের দেখালাম। ওরা মুগ্ধ হয়ে দেখল। আবার আর কয় পাক দিয়ে আমরা এসে গেলাম মাকাইবাড়ী চা বাগানের কাছে। সুন্দর ধাপে ধাপে সাজান এই বিশ্ব বিখ্যাত চা বাগান। ওখান থেকে আর উপরে উঠে আমরা ঢুকে পরলাম কার্সিয়াং এ। আমি ডেনজং রেষ্টুডেন্টে ওদের মোমো খাওয়ালাম। তারপর ঠিক করলাম কার্সিয়াং বাজারে ঘোরার আগে আমরা ডাওহিলে ঘুরে আসব। আমরা উঠে গেলাম ডাওহিলের দিকে। ঘন কুয়াসা ঠান্ডার ভিতর আমরা উঠতে লাগলাম। দুপাশে সুন্দর সুন্দর বিশাল বাড়ি লন ফুলের বাগান পার হয়ে এলাম বিশাল ভিক্টৌরিয়া স্কুলের সামনে। অত বড় স্কুল দেখে ওরা অবাক হয়ে গেল। এর পর কিশোর গিয়ে দাড়াল ফরেষ্টের মিউজিয়ামে র সামনে। বিশাল বিশাল পাইন ধূপি দেবদারুর অরন্যের ভিতর ঘন মেঘের খেলা। আমরা এখানে নামলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা ঘন কুয়াশা। আমাদের কারোরই শীতপোষাক নেই। ওরা দুজন ঠক ঠক কাপতে লাগল। মিষ্টু বলল আপনারা যান আমি গাড়ির ভিতরই বসছি। কিশোরের একটা কম্বল ছিল ওটা মুরি দিয়ে থাকল। আমি আর নীলিমা পাহাড় বেয়ে কিছুটা উঠে একটা জায়গা থেকে নিচের দিকে তাকালাম। মেঘ আর আলোর খেলা চলছে। আমি ওকে নিচে কার্সিয়াং শহর দেখালাম। এবার দেখি ও কাঁপছে। জিজ্ঞাস করলাম ফিরে যাবেন। বলল না ঠিক আছে। একটু পরে দেখি দাতে দাত লেগে যাচ্ছে। সব লজ্জা বাদ দিয়ে আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। হাতে হাত নিয়ে ঘসতে লাগলাম। ও আবেশে আমার কাধে মাথা দিয়ে থাকল। কতক্ষন ছিলাম জানি না। হঠাৎ পিছন থেকে কিশোর বলল ফরকানো পরছ(ফিরতে হবে। )আমরা কার্সিয়াং এ ফিরে এলাম। বাজার গিয়ে ওরা দুজনে দুটো সোয়টার কিনল। আমাকে একটা ব্রাসের জিনিষ কিনে দিল। আমি ওদের দুজনকে হিল ক্সল কিনে দিলাম। একটু রাস্তা দিয়ে হাটলাম। বেশ বিদেশ বিদেশ লাগে। তারপর আমরা তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম ছটার মধ্যে।কিশোর চলে গেল। আমি ওদের হোষ্টেলে পৌছে দিলাম। ঢোকার সময় নীলিমা আস্তে আস্তে বলল ধন্যবাদ।
সাতটার মধ্যে কিশোর গাড়ি নিয়ে এল। আমি ওদের তুলতে গেলাম। ওরা সেজে গুজে রেডি হয়ে ছিল। আমি আমার মিউজিক সিষ্টেম নিয়ে গেলাম।আমি রাস্তায় ওদের জিজ্ঞাস করলাম কাল কি করে যাবে। ওরা বলল সেটাই চিন্তা সকালের বাস ছারবে পাঁচটার সময়।কি করে যে শিলিগুড়ি যাব তাই চিন্তা করছি। আমি বললাম কিশোর ভরসা। ওরা হেসে উঠল। কিশোরকে জিজ্ঞাস করলাম কাল পাঁচ টার ভিতর পৌছে দিতে পারবে কি না। বলল হয়ে যাবে। আপনারা সারে চারটির মধ্যে রেডি হবেন। ফান্সন শুরু হয়ে গেছিল। সারা মাঠ জুড়ে ভীড়।
আলোর মালা। শিবু সেন বলল ঠিক সময় চলে আসছিস। ওদের এখন ই প্রোগ্রাম দিয়ে দিচ্ছি। নীলিমা প্রথমে একটা রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে হবার মন জয় করে নিল। তার পর চমকে দিয়ে রাগাশ্রয়ী হিন্দি গান গাইল। তারপর বাংলা হিন্দি মিলিয়ে আরও চারটি গান গাইল। দর্শকরা প্রচুর হাততালি দিল।
এর পর আমরা নীলিমা আর মিষ্টুকে কিশোরের গাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। বললাম সারে চারটার আগে যেন রেডি থাকে।যেহেতু ওর বাস আমার শহর হয়ে যাবে সেইজন্য আমিও ঐ বাসেই যাব।
শিবু সেন বলল ভালো ই তো ফিট করছিস। এর পর গান শুনবি। আমি কাল সকালের গাড়ির কথা বললাম। বলল নো চিন্তা।গাড়ি ভাড়ার কথা বললাম। বলল ভালো করে খেল।তাহলেই হবে। আমাদের প্রোগ্রাম গ্রান্ড সাকসেস হল। রাত বারোটায় হোষ্টেলে ফিরলাম।
পরদিন সকাল সারে চার টার আগে লেডিস হোষ্টেলে গেলাম। দেখি কিশোর গাড়ি নিয়ে এসে গেছে। একটু পরে ওরা নামল। আধা ঘন্টার ভিতর আমরা বাস স্টান্ডে পৌছে গেলাম। বাসও দিয়ে দিল। ওরা আমার ঠিকানা ফোন নম্বর নিল।আমরা পাশাপাশি তিনটা সিট নিলাম। নীলিমা আমার কাধে মাথা রেখে চুপ করে থাকল। এক ঘন্টার মধ্যে জলপাইগুড়ি এসে গেল। আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পরলাম। নামার আগে নীলিমা আমায় একটা চিঠি দিল। বলল ভাল থাকবেন।
পূজা শুরু হয়ে গেল। আমার কাজ আর কি।দিনের বেলা পূজা সংখা গুলি জোগার করে পড়া। আর রাত্রে সেজেগুজে পূজা মন্ডপের কাছে দাড়ান। মেয়ে দেখা কিংবা একটু টাঙ্কি মারা। সবাই ঠাকুর দেখতে ঘুরে বেড়ায়।বন্ধুরা একটু মাল খায় হুজ্জুতি করে কেউ কেউ মেয়েদের পিছনে পিছনে যায় কেউ আবার গার্লফেন্ডের সঙ্গে রঁদেভু করে আমি ও সবের মধ্যে যাই ই না। আমি পূজা মন্ডবের আগে কালুর দোকানে বসে থাকি।লোকজন দেখি। এবার দেখলাম বীরেনবাবুর মেয়েটা খুব বাড়াবাড়ি করছে। খুব একটা পাত্তা দিলাম না।বাড়িতে কেউ আমাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমি একদিন জোতের দিকে বেড়িয়ে পরি। চমৎকার সবুজ ধান ক্ষেত মাঝে মাঝে ছনের,টিনের বাড়ি। জমির একটু আগে টানিং থেকে কান্চনজঙ্ঘা ঝকঝকে রোদে আমাকে স্বাগত জানাল। আমি প্রজাদের(বর্গাদার) মধ্যে দেওনীয়া কদুর বাড়িতে যাই। ওরা সমাদর করে বসতে দেয় দেশী চূড়া চা খাওয়ায়। ওদের বাড়ি থেকে যাই আমাদের টিলার উপর সেখান থেকে দেখি চা বাগান দূরে বাধের ওপারে তিস্তার আভাস মাথার উপর কান্চন জঙ্ঘা। আসবার সময় ওরা দেয় ননীয়া চাল আর লাউ।আমি ফিরে আসি লোকজন ঢাক মাইকের চিৎকারে আবার সন্ধায় সেজেগুজে পূজা মন্ডবের সামনে।
নবমীর রাত্রে বিচিত্রানুষ্ঠানে আমাদের অর্কেস্ট্রা পার্টির সঙ্গে বাজনা বাজাই। এবার আমি রোজ রাত্রে বাজাতে যাই না।
পূজার ছুটি শেষ হয়ে যায়। আবার ফিরে আসি ইউনিভার্সিটিতে। সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করি।নীলিমাকে দেখে মন খুসি হয়ে যায়।নীলিমার মুখটাও উজ্বল হয়ে উঠে।আজ ক্লাশ হয় না। ওকে ডেকে নিয়ে যাই কফিহাউজে। ও বলে একদিন আমি তোমার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। তুমি বাড়ি ছিলে না। বলল পড়াশুনা কেমন করলে। বললাম এক দিনও না। খালি তোমার কথা চিন্তা করেই সময় কেটে গেল। হেসে বলল ইয়ারকি হচ্ছে।সত্যি আমারও মন একদম বসেনি। এদিকে বিয়ের প্রোপজাল এসেছে পাকিস্তান থেকে। ডাক্তার ইংল্যান্ডে থাকে। বললাম বেশ তো করে ফেল। আমাকে নিমন্ত্রন কোর। বলল তোমার আর কি। আমার যে কি অবস্থা।বলে ব্যাগ থেকে একগাদা নোটস বার করল।বলল জানি তুমি তো আর কিছুই নোটস কর নি আমি তোমার জন্য কপি করেছি। বললাম যখন এত কষ্ট করেছ তখন এককাপ চা খাও। ও হেসে বলল খালি ইয়ারকি।মিষ্টু একটা কথা বলেছে তুমি আসলে খুব ভালো ছেলে। বললাম পড়াশুনা ছাড়া। ও হেসে বলল খালি ইয়ারকি।
এর পর থেকে আমরা অনেক কাছাকাছি এসে গেলাম। ক্লাশে পাশাপাশি বসি এক সঙ্গে চা খাই। বিকালে গল্প করি। পুরো ইউনিভার্সিটি জানাজানি হয়ে গেল। আমাদের মেলামেশাতে দুজনেরই লাভ হয়েছে। নীলিমা অনেক সপ্রতিভ হয়ে গেল। পোষাক পালটে গেল। অনেক মিশুকে। আর আমি যে বই উল্টাই না সে কিনা ক্লাশ পরিক্ষায় অনেক ভালো রেজাল্ট করল। নীলিমা যথারীতি ফাষ্ট।
একদিন দেখি নীলিমার মুখ খুব গম্ভীর। টিফিনে বাইরে এল না। বিকালে ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার? ও কিছু না বলতে না চাইলেও আমার বারবার অনুরোধে বলল যে ওদের মুসুলমানদের একটা ইউনিয়ান আছে। মাঝে মাঝে ওরা বসে। ওখান থেকে ওকে থ্রেট করেছে ও যেন আমার সঙ্গে না মেশে নাহলে কমিটি ওকে বয়কট করবে। ওর বাড়িতে খবর যাবে।আমারও এক প্রকার চাপ এল। একদিন হেড অফ ডিপার্টমেন্ট ডেকে বলল তোমারে একটা কথা কই কিছু মনে কর না। নীলিমা তো খুব ভালো মেয়ে ওতো রেকর্ড করবই । কিন্তু এত মেলামেশা ভাল নয়।তুমি নামকরা ফ্যামেলির ছেলে যা শুনছি ও ও বেশ নামকরা ফ্যামেলীর মেয়ে। তোমাদের এ সব শোভা পায় না। চুপ করে ঠিক আছে স্যার বলে চলে এলাম।
সেদিন বিকালে নীলিমাকে আর পেলাম না। ওর বন্ধু মিষ্টু এসে আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। দেখলাম নীলিমা লিখেছে এখন থেকে আর দেখা করা সম্ভব হবে না। আমি যেন ও কে ভূলে যাই। পরদিন ক্লাশে ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। ও কথাই বলল না। খালি বলল আমি ব্যস্ত আছি। আমি চুপ করে থাকলাম। ক্রিকেটের ইন্টার ইউনিভার্সিটি খেলা শুরু হবে আমাদের ক্যাম্পাসের মাঠে আমি তাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। নীলিমাও ক্লাশ ছাড়া বাইরে আর আসত না।
সময় কাটে একই রকম ভাবে। এখন আমি একটু পড়াশুনায় মন দিয়েছি। সেই সঙ্গে খেলা।রেগুলার ক্লাশ করি খেলা না থাকলে। ক্লাবে কমই যাই। শিবু সেনও অবাক হয় কি হোল বস। ভালো খেললে ভালো বাজালেই হবে না। একটু ফুর্তিও করতে হবে।ক্লাবের ম্যাচগুলো জান দিয়ে লড়ে যাই।ভালো রেজাল্ট পাই।ক্রিসমাসের পর কয়েক জায়গায় ফাংসনে বাজাই। সমর্থক বারে।
ক্লাশে একদম কিনারে বসি।ওখান থেকে নীলিমাকে দেখাই যায় না। অফ প্রিয়ডে বাইরে প্রফেসারদের ক্যান্টিনে চা খাই। চুপচাপ বসে থাকি।আলপনা বাসু মাঝে মাঝে এসে গল্প করে।আমি হু হা করে যাই। সকালে সন্ধায় ঁ
ব্যায়াম করি। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়।
একদিন রিসেস প্রিয়ডে প্রফেসারদের ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি নীলিমা এসে সামনে দাড়ায়। চমকে উঠি। বলে তোমার সঙ্গে জরুরী কথা বলতে চাই সময় হবে।তাড়াতড়ি ওকে পিছনের করিডরে নিয়ে যাই। ওর দিকে ভালভাবে তাকাই দেখি চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে।অনেকক্ষন মাথা নিচু কোরে থাকে তারপর বলে আমি নিজের সঙ্গে এ কদিন খুব লড়াই করলাম কিন্তু পারলাম না। তুমি***। আমি ওর হাত চেপে ধরলাম বললাম আমি তোমার জন্য চিরদিন আছি। নীলিমা ঝড়ঝড় করে কেঁ দে ফেলল। আমি বললাম এ কি তুমি কাঁদছ কেন? এই একটু হাস। নীলিমা চোখ তুলে তাকিয়ে বলে অনেক বাধা আসবে কিন্তু। বললাম জান হাজির। ও হেসে ফেলল। আমি ক্যান্টিনে গিয়ে দুকাপ চা অর্ডার করলাম।লক্ষ করলাম অনেকে আমাদের লক্ষ করছে।
এরপর আমরা আবার আগের মত হয়ে গেলাম। ছুটির দিন ঘুরে বেড়াতাম যেখানে পাহাড় শুরু হয়েছে সেই পাহাড় ঘুমিয়ায় ছোট্ট ডুডুয়া নদীর পার দিয়ে হেটে চা বাগানের ধারে। উচু নিচু চা বাগানের ঢালে গিয়ে বসে থাকতাম। মাখন রঙা রৌদ্র আমাদের ভিজিয়ে দিত। ফাকা জায়গায় নীলিমা আমাকে গান শোনাত। ক্লাশে আমরা দূরে দূরেই থাকতাম কফিহাউজে একসঙ্গে যেতাম না। এর মধ্যে আমি ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট খেলে এলাম গৌহাটীতে। নীলিমাও উত্তরবঙ্গ ভাওয়াইয়া কমপিটিশনে ফাষ্ট প্রাইজ পেল।
ফিপট ইয়ারের পরিক্ষা হয়ে গেল। ভালোই পরিক্ষা দিলাম নীলিমা তো খুব ভালো দিল।ছুটিতে আমরা যে যার বাড়িতে চলে গেলাম। ও যাবার সময় বলে গেল ভালো থেক।
রেজাল্ট বের হয়ে গেল নীলিমা ফাষ্ট প্রায় 56% । আমিও ভালভাবে পাস। এর মধ্যে কয়েকটা ইন্টারভিও দিলাম। যদি চাকরি পাই তবে আমাদের সুবিধা হবে।
ক্লাশ শুরু হল। নীলিমা এল না। কদিন পরে মিষ্টু এল। ও আমাকে ডেকে বলল মারাত্মক খবর। নীলিমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ও অনেক চেষ্টা করেছিল তোমাকে খবর দিতে। ওর আব্বা ওকে ভয় দেখিয়েছে তোমাকে এদিকে দেখলে গুন্ডা দিয়ে মেরে ফেলবে।নীলিমা পাঁচ দিন না খেয়ে ছিল। অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে কোচবিহারের নার্সিহোমে দিতে হয়েছিল। ওর বিয়ের ফটো দেখাল। হাজবেন্ড বিলাতে ডাক্তার। ও পাকিস্থানের নীলফামারী বলে একটা জায়গায় শ্বশুর বাড়িতে গেছে। মাস খানেক পরে ইউনিভার্সিটি তে আসবে। আমি কিছু ক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম। তার পর উঠে হোষ্টেলে চলে গেলাম। সন্ধায় শিবু সেন বলল গুলি মার। তুইও দেখিয়ে দে তুই কি করতে পার।
আবার পুরানো জীবনে ফিরে গেলাম ক্লাশ ব্যায়াম অক্রেষ্টা আড্ডা সব চলতে লাগল। আবার ইনা মিনা ডিকাদের সঙ্গে র্যঁদেভূ।মিষ্ঠুর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়। ওর কাছে শুনি নীলিমা ইংল্যান্ডে চলে গেছে। খালি পরিক্ষার দিতে আসবে। ডিপার্টমেন্ট পারমিশান পেয়ে গেছে।
একটা রাষ্টয়ত্ব ব্যাঙ্কে ইনটারভিউ দিয়েছিলাম। ঐ চাকরিটা আমি পেয়ে যাই। শিলিগুড়িতে পোষ্টিং। হেড কে বললাম। বলল আ্যাপ্লাই কর পারমিশন দিয়ে দেব। পারমিশন পেয়ে হোষ্টেল থেকেই যাতায়ত করি। পড়াশুনা করি রাত্রে ক্লাবে যাই।আর একটা গুন হয়েছে মেয়েদের সঙ্গে ফ্লাটারি। মেয়ে জুটেই যায়। একজনের সঙ্গে কিছুদিন আবার আর একজনের কিছুদিন এই চলাই। কাউকে মনে নিইনা। মিষ্টুর সঙ্গে দেখা হয় বলে তুমি এরকম হয়ে যাচ্ছ কেন? বলি এই তো জীবন।
ফাইনাল পরিক্ষা এসে পরে নীলিমা এসে শিলিগুড়িতে হোটেলে উঠে। সঙ্গে ওর বাবা। রোজ বাবার সঙ্গে আসে। পরিক্ষাতেও ও অন্য দিকে বসে আমার সঙ্গে দেখা হয় না। শেষ পরিক্ষার দিন মিষ্টু বলে তোমার সঙ্গে নীলিমা একটু দেখা করতে চায়। প্রথমে বলি কি দরকার তারপর রাজি হই। সেই ইউ ক্যালিপটাস বনের ভিতর দাড়াই। নীলিমা আসে। বলে ভাল আছ। বলি কেন থাকব না ফাইন। দেবদাস হবার কোন ইচ্ছা নেই। ও মাথা নিচু করে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে বিশ্বাস কর আমি ভালো নেই। দেখি ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে। বলে মরতে চেয়েছিলাম কিন্ত মরতে পারলাম কই।কিছুক্ষন দুজনে চুপ করে থাকি। তারপর ও বলল ভালো থেক। মনে রেখ।
.আশিস সরকার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন